স্টাফ রিপোর্টার, বেনাপোল (যশোর): আম্পানে এলাচ চাষি মো. শাহজাহানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যে পরিমাণ ফল ধরেছিল গাছে, তাতে কয়েক লাখ টাকার এলাচ বিক্রি হতো। কিন্তু ঝড়ে গাছগুলো মাটির সাথে মিশে যায়। কিন্তু থেমে নেই তিনি। নতুন করে চারা তৈরি করছেন দেশের প্রথম এলাচ চাষি যশোরের বেনাপোল এলাকার শাহজাহান আলী।
ভোজনপ্রিয় বাঙালির রসনাবিলাসে বহুকাল আগে থেকেই রান্নায় ব্যবহৃত হয় ঔষধিগুণসমৃদ্ধ সুগন্ধি এলাচ ফল। চাহিদার যোগান দিতে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় এলাচ। দেশে এলাচের বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেন সৌখিন চাষি মো. শাহজাহান আলী।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে একাধিকবার ক্ষতির শিকার হয়েছেন মো. শাহজাহান; কিন্তু হাল ছাড়েননি। কৃষিবিভাগ ও মসলা ইনস্টিটিউশনের কর্মকর্তারা একাধিকবার তার ক্ষেত পরিদর্শন করেছেন। তবে, তাদের কাছ থেকে যুতসই কোনো পরামর্শ পাননি।
তিনি জানান, বাণিজ্যিকভাবে এলাচ চাষে আগ্রহীরা তার কাছ থেকে চারা নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় চাষাবাদ করছে। ঝড়ে নষ্ট হওয়ার পর এখন বীজতলা তৈরি করছেন। যেখানে প্রায় ২৫ হাজার চারা হবে। চারা বড় হলে নিজে কিছু রোপণ করবেন বাকিটা আগ্রহী চাষিদের কাছে বিক্রি করবেন তিনি।
একটা চারা কমপক্ষে ৩০ বছর পর্যন্ত ফল দেয়। এলাচ খুব লাভজনক চাষ। প্রতি একর জমিতে ১২শ’ চারা রোপণ করা যায়। যা থেকে এককালীন প্রায় ১৫ লাখ টাকার এলাচ বিক্রি করা সম্ভব। অন্য কোনো চাষে এত লাভ হয় না। বর্তমান বাজারে গ্রেড ভেদে এলাচ ২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হয়।
২০১২ সালে বেনাপোল পৌরসভার সামনে পাটবাড়ি এলাকায় এক বিঘা জমিতে দুই জাতের এলাচ চাষ শুরু করেন শাহজাহান আলী। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এলাচ চাষের বিষয়ে জানতে পারেন। বহু কষ্টে বিদেশ থেকে এলাচ গাছের মূল সংগ্রহ করেন ৭০টি। এলাচ গাছ বীজ থেকে নয়, মূল থেকেই জন্ম নেয়। যে কোনো ছায়াযুক্ত স্থানে এই চাষ করা যায়। বাংলাদেশের আবহাওয়া এলাচ চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বেলে দোআঁশ জমিতে মূল রোপণ করেন। এখানে মাটির সমস্যার কারণে ২০১৬ সালে এক একর জমি লিজ নিয়ে নারায়ণপুর গ্রামে নতুন করে সবুজ এলাচ চাষ শুরু করেন। সেখানে ৬০০টি এলাচের ঝাড় ছিল। প্রতিটি ঝাড়ে ১শ’ থেকে ১শ’ ১০টি গাছ হয়। ফলন আসার সময় হানা দেয় আম্পান। তাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায় শাহজাহানের।
শাহজাহান আলী বলেন, প্রথমে অন্য ফসলের মাঠে এলাচ চাষ করি। কিন্তু ফলন ভালো হয়নি। পরে একটি মেহগনি বাগান (গাছের ছায়াযুক্ত স্থান) লিজ নিয়ে চাষ করি। এতে আগের চেয়ে ফলন ভালো হয়। কিন্তু আম্পান ঝড়ে সব গাছ নষ্ট হয়ে যায়। যে ২/৪টি গাছ আছে, তাতে ফল ধরছে না। ২০১৬ সালে যে গাছ রোপণ করা হয় ২০১৯ সালে তাতে কিছু ফল এসেছিল। যেটা বিক্রির পর্যায়ে ছিল না। প্রথম ফল সে কারণে কিছু আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পরীক্ষার জন্য দেওয়া ও রাখা হয়।
তিনি আরো বলেন, যে কেউ বাড়ির আঙ্গিনা অথবা ফলদ বৃক্ষের বাগানে এ জাতের সবুজ সুঘ্রান এলাচ চাষ করতে পারবে। সরকার যদি বাণিজ্যিকভাবে এলাচ চাষে আগ্রহীদের আর্থিক সহযোগিতা করে তাহলে খুব অল্প সময়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে।
এলাচ চাষ শুরু পর বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইন্সটিটিউট বগুড়ার মসলা গবেষনা কেন্দ্রের একদল বৈজ্ঞানিক আসেন এ এলাচ চাষের ফলন দেখতে। পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য তারা বাগান থেকে নমুনাও সংগ্রহ করে নিয়ে যান। তারপর থেকে তারা আর কোনো খোঁজ খবর নেয়নি।
বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. কলিম উদ্দীন বলেন, এলাচ চাষ নিয়ে মসলা গবেষণা ইনসটিটিউট দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। বেনাপোলের এলাচ একটি ভিন্ন ধরনের জাত, এই এলাচের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়াতেও এলাচ চাষ সম্ভব তার প্রমাণ এই বেনাপোল। শাহজাহান যে এলাচের চাষ করছেন সেটির ঘ্রাণ রয়েছে ভাল।
শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৌতমকুমার শীল জানান, শাহজাহান দেশের প্রথম এলাচ চাষি। আম্পান ঝড়ের আগে ও পরে তার এলাচ বাগান আমি এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কয়েকবার পরিদর্শন করেছেন। মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ অনেক কর্মকর্তা গিয়েছেন তার বাগানে। বাণিজ্যিকভাবে দেশে প্রথম চাষ শুরু করলেও আম্পানে শেষ। এখন ফের চারা করা হচ্ছে। গাছ রোপণ করলে আবারো ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন শাহজাহান।
তিনি বলেন, তাকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।