আহসান কবীর
আলী রেজা রাজুর মৃত্যুসংবাদ যখন পৌঁছালো তার অল্পসময়ের মধ্যেই কথা বলেছিলাম তার দুই বন্ধু তরিকুল ইসলাম ও খালেদুর রহমান টিটোর সঙ্গে। আবার তরিকুল ইসলামের মৃত্যুর পর পরই কথা হয়েছিল খালেদুর রহমান টিটোর সাথে। তারা যে ভাষায় অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন, আমার বিবেচনায় তা শুধু রাজনৈতিক শিষ্টাচারের প্রকাশই ঘটায়নি বরং তাতে ‘কখনো বন্ধু কখনো শত্রু’র প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা-শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ ছিল।
আজ খালেদুর রহমান টিটোর মৃত্যুসংবাদ এলো। কিন্তু হায়! আজ অনুভূতি জানতে কার ইন্টারভিউ নেব? বর্ষীয়ান রাজনীতিক, যারা যশোরের অভিভাবক হিসেবে গণ্য, তাদের কেউ তো আর রইলেন না।
স্মৃতি যদি বিভ্রান্ত না করে তাহলে বলতে পারি, যেদিন দুপুরে আলী রেজা রাজু মারা যান, তার কিছুসময় আগে তরিকুল ইসলাম সপরিবারে ঢাকা গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হননি তরিকুল। আমাকে বলেছিলেন, ‘শরীরটা খারাপ। কিন্তু উপায় নেই। বন্ধু রাজুর মৃত্যুসংবাদ পেলাম এইমাত্র। আমি তার পরিবারের পাশে দাঁড়াবো না- তা কি হয়?’
কথা অনুযায়ী বিকেলের ফ্লাইটেই যশোর ফিরেছিলেন তরিকুল ইসলাম। অসুস্থ শরীরে বিমানবন্দর থেকে সোজা গিয়েছিলেন রাজুর ঘোপের বাড়িতে। সেখানে মরদেহের পাশে দীর্ঘসময় অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন। শত-সহস্র লোক তরিকুলের সেই ক্রন্দনদৃশ্য দেখেছিলেন।
আবার তরিকুল ইসলামের মৃত্যুসংবাদ শুনে ফোন করেছিলাম খালেদুর রহমান টিটোকে। তিনিও তখনই খারাপ খবরটি জানতে পেরেছেন। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তিনি আমাকে কিছু কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে একটি কথা আজও মনে গেঁথে আছে- ‘যশোরবাসী বুঝতে পারবে তারা কী হারালো’।
তরিকুল-টিটো-রাজু তিন বাল্যবন্ধু- একথা সবাই জানেন। লেখাপড়া থেকে রাজনীতির মাঠে বেড়ে ওঠা একই সময়কালে। তিনজনই ছিলেন জনপ্রতিনিধি। কোনো কোনো সময় তারা ছিলেন একই কক্ষপথে। আবার কখনো বা ভিন্ন মেরুতে। ভিন্ন শিবিরে অবস্থানকালে তাদের রাজনৈতিক বিরোধ ছিল প্রকাশ্য। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর তার কোনো প্রভাব দৃশ্যমান হয়নি। মধু সুইটস বা অন্য কোথাও একই টেবিলে চা পান করতে করতে ধুমছে আড্ডা দিয়েছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন একই রিকশায়। টাউন ক্লাবের তাসের টেবিলেও তাদের সহাবস্থান কারও চোখ এড়ায়নি।
একটা সময় এই তিন মহাতারকা যশোর নিয়ন্ত্রণ করতেন। তখনো সমাজ কলুষমুক্ত ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক সহনশীলতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ একেবারে উবে যায়নি। রাজপথে মারপিট হয়েছে দুই দলের মধ্যে। কিন্তু দিনশেষে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত রাজনৈতিক দলের এই শীর্ষনেতাদের খোশগল্প কর্মীদের মধ্যে ভিন্ন মেসেজ দিতো। পরিস্থিতি দ্রুতই শান্ত হয়ে যেত। কোথায় গেল সেই দিনগুলো!
রাজনৈতিক কর্মী এবং পরে সংবাদকর্মী হিসেবে এই তিন নেতার সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল। বয়সে আমি তাদের অনেক ছোট; কার্যত সন্তানতুল্য। সেই কারণেই হয়তো তারা আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তিনজনই আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তা সত্ত্বেও কখনো তাদের মধ্যে জড়তা দেখিনি। খোলামনে বলতেন অনেক কথা।
তরিকুল ইসলাম ছিলেন আসর জমানো মানুষ। যেখানেই বসতেন, চারপাশে লোকজন গিজগিজ করতো। কথা তিনিই বেশি বলতেন, অন্যরা মূলত শ্রোতা। কোনো বিতর্ক শুরু হলে প্রায়ই আমাকে বলতেন, ‘তুমি তো কমিউনিস্ট। তুমি তো এমন কথাই বলবে।’ কার্যত আমি ‘অবসরপ্রাপ্ত কমিউনিস্ট’ জানালে তিনি হাসতে হাসতে বলতেন, ‘ওই হলো আর কী।’
বাম ধারার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল তরিকুল ইসলামের- এই কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি নির্দ্বিধায় বলতেন, ‘ওটা তো রাজনীতিকদের শিক্ষালয়।’
আলী রেজা রাজুর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক আলাপ হতো না বললেই চলে। কথা হতো মূলত সংবাদ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে। প্রায়ই টেলিফোনে। এই মানুষটির একটি গুণ আমাকে মুগ্ধ করতো। শেষ জীবনে তিনি রোগে কাতর ছিলেন। কিন্তু কখনো আমি আগে তার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে পারিনি। ফোনের ওপার থেকে আগেই আমার কুশল জানতে চাইতেন। তারপর বলতেন, ‘বল, কী জানতে চাস।’
সদ্যপ্রয়াত খালেদুর রহমান টিটোর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক আলাপ হতো মূলত ২০০০ সালের পর থেকে। অনিয়মিত। তরুণ এই আমি কখনো সখনো বেফাঁস মন্তব্য করে বসতাম। তিনি হাসতেন। তারপর ভুল ভাঙিয়ে দিতেন। ব্যাখ্যা করতেন প্রকৃত অবস্থা। ভাঁড়ারে থাকা রাজ্যের তথ্য দিতেন। শুনতে শুনতে ভাবতাম, জম্পেশ একটা স্টোরি হবে। কিন্তু শেষে বলতেন, ‘লিখে দিসনে যেন। বেকায়দায় পড়ে যাব কিন্তু।’
যশোরের এই তিন নেতা সম্বন্ধে বলার আছে আরো কত কী! আমার চেয়ে ঢের বেশি তথ্যসমৃদ্ধ লেখা দাঁড় করাতে পারবেন- এমন লোকের সংখ্যা অগুনতি। কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায়, লিখতে চাইবেন না কেউই। কী কারণে লিখতে চান না, সবাই তা বোঝেন।
যা-ই হোক, যশোরের রাজনীতির শেষ নক্ষত্র ঝরে গেল। পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিকরাও হয়ে উঠুন একেকজন তরিকুল-টিটো-রাজু। পূর্বসূরিদের দেখানো পথেই তো পৌঁছানো যায় গন্তব্যে।
লেখক : সম্পাদক, সুবর্ণভূমি ও প্রেসক্লাব যশোর